শুক্রবার, জানুয়ারী ০৬, ২০১২

ভ্রমণ : দিল্লী থেকে অমৃতসর ... স্বর্ণমন্দির ছুঁয়ে একটি ঝটিকা সফর




শুরুর কথা

ছয় সপ্তাহের ট্রেনিং-এ মুন যখন দিল্লী উড়ে গেল সবচেয়ে খুশি হলাম আমি। যাক দিল্লীতে আরেকটা সফরের অজুহাত পাওয়া গেল। দুজনে ঠিক করলাম ট্রেনিং-এর পঞ্চম সপ্তাহে আমি দিল্লী যাব, সুযোগমত ঘুরবো এবং ফিরে আসার সময় ওর বাড়তি জিনিসপত্র নিয়ে আসবো। সে মতে একা একা বাসে ঢাকা থেকে কলকাতা, সেখান থেকে রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লী। একা ভ্রমণ করার একটা আলাদা মজা আছে। বিপুল স্বাধীনতা, কোন বাড়তি দায়িত্ব নাই, নির্ভার হয়ে ইচ্ছে হল থামলাম ইচ্ছে হলো চললাম। তো এই করে আগের দিন কলকাতা শেয়ালদা ষ্টেশন থেকে বিকাল ৪:৫০ টায় রাজধানী এক্সপ্রেসে রওনা দিয়ে পরের দিন নির্ধারিত সময় সকাল ১০:২০ টার স্থলে ঠিক ১০:৪৫ টায় নিউ দিল্লী রেলষ্টেশনে ঢুকলাম। এর আগে দুবার এসেছি এখানে। ষ্টেশন থেকে বের হয়ে প্রথম কাজ হল উল্টোদিকে পাহাড়গঞ্জের একটা লস্যির দোকানের লস্যি খাওয়া। এত সুস্বাদু লস্যি কোথাও খাই নাই। প্রথমবার দিল্লী এসে এই ছোট্ট দোকানটার খোঁজ পেয়েছিলাম।

মুনদের হোস্টেল ছিল কোরলবাগ বলে একটা জায়গায়। মধ্যমমানের হোটেল ও বিভিন্ন সেরা ব্র্যান্ডের শপিংমলের জন্য বিখ্যাত। দিল্লী মেট্রো সার্ভিসের একটা ষ্টেশন কোরলবাগের পাশ ঘেঁষে থাকাতে ওখান থেকে শহরের অন্যান্য জায়গার যোগাযোগ ব্যবস্থাও বেশ সুবিধাজনক। সোম থেকে শুক্র সকাল ৯টা-৩টা টানা ক্লাস, শনি-রবি বন্ধ। ট্রেনিং ক্লাস বাদ দিয়ে কোথাও যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। কাজেই দিল্লীর বাইরে বেড়াতে হলে উইকএন্ডের ঐ ২দিনই ভরসা। ভ্রমণে ট্রেন সবসময়ই আমাদের প্রথম পছন্দ। কিন্তু বিশাল ভারতের কোথাও ট্রেনে বেড়ানোর পক্ষে ২দিন খুবই অপ্রতুল সময়। দুজনে ভেবে ভেবে কিছুই ঠিক করতে পারি না, অথচ দ্রুত শনিবার কাছিয়ে আসছে। আগ্রা, জয়পুর কিংবা আজমীর - ১ দিনেই ঘুরে আসা যায় দিল্লি থেকে। কিন্তু সবগুলো জায়গাতেই আগে গেছি দেখে বাতিল করে দিলাম। অবশেষে ঠিক করলাম রেলষ্টেশনে গিয়ে নতুন যে যায়গার টিকেট পাবো সেখানেই যাব। সিদ্ধান্ত নেয়া হতেই বেশ একটা এ্যাডভেঞ্চার ভাব চলে আসলো।


নিউ দিল্লী ষ্টেশনের দোতলায় বিদেশীদের জন্য টিকেট কাটার একটা হলরুম আছে। সারি সারি টেবিলে কম্পিউটার নিয়ে বসে আছেন রেলওয়ে অফিসাররা। সবগুলোর সামনেই বিদেশীদের ছোট ছোট লাইন। ভারতে যে কোন রেল রুটেই টিকেটের প্রচুর চাহিদা, ক্ষেত্রবিশেষে ৬ সপ্তাহ আগে থেকে টিকেট বুক করতে হয়। তবে আশার কথা, বিদেশীদের জন্য বিভিন্ন গন্তব্যের কিছু না কিছু টিকেট সংরক্ষিত থাকে। ভারতীয় ও আমাদের গায়ের রং এক হলেও সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে আমরা বিদেশী কোটার সুবিধা নিতে বৃহস্পতিবার বিকালে হলরুমে গিয়ে ঢুকলাম। রুমের মাঝে দাঁড়িয়ে দয়ালু চেহারার এক জন টিকেট অফিসার খুঁজছি, যার কাছে বিফল হতে হবে না। শেষমেষ সবচেয়ে ছোট লাইনটার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের পালা আসতেই হিন্দীভাষী অফিসারকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম আমরা কি চাই। উনি হড়বড় করে যা বললেন তার সারমর্ম হল আমরা কোথায় যাব সেটা আমাদেরকেই ঠিক করতে হবে, উনি কোন সাজেশন দিতে পারবেন না। আমাদের কথা শুনে পাশ থেকে আরেকজন অফিসার খাঁটি বাংলায় জিজ্ঞেস করলেন, কি বাংগালী নাকি? আহ, কানে মধু বর্ষণ করল কথাটা। উনিই হাতছানি দিয়ে আমাদের ডেকে নিলেন। পরিচয় হল সুধীরদার সাথে, পরামর্শ দিলেন ভুপাল অথবা অমৃতসর যান ... ২দিনেই বেড়িয়ে আসতে পারবেন। দুই শহর থেকেই দিল্লীতে বাস, ট্রেন বা প্লেনে আসা-যাওয়া করা যায়। কিবোর্ডে অনেকক্ষণ খুটখাট করে বললেন ভুপালের টিকেট নেই, তবে অমৃতসরের একটা স্পেশাল ট্রেনের টিকেট আছে তাও শনিবার রাতের। যেহেতু ডিসেম্বর মাস, টুরিষ্ট সিজন, তাই টিকেটের এই আকাল। শনিবার সারারাত কমপক্ষে ৮ ঘন্টার জার্নি, পৌঁছুব রোববার ভোরে, সারা দিন অমৃতসর দর্শন এবং ঐদিনই আবার রাতের ফিরতি যাত্রায় দিল্লী। কারণ সোমবার সকাল ৯টায় মুনের ট্রেনিং ক্লাস, মিস করা যাবে না। যা থাকে কপালে, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে দুটো টিকেট কেটে ফেললাম। এখন যাওয়ার ব্যবস্থাতো হল, আসার? অমৃতসর থেকে ট্রেনের ফিরতি টিকেট পাওয়ার আশা নেই বল্লেই চলে। সুধীরদাই বুদ্ধি দিলেন ভলভো বাস চলে দুই শহরের মধ্যে, টিকেটও সহজলভ্য এবং ট্রেনের তুলনায় সস্তা। সো নো চিন্তা! 
======================================



যাত্রা পথে

নতুন একটা জায়গা দেখা হবে এ আশায় অধীর হয়ে দুজন নিউ দিল্লী রেল ষ্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। ছাড়ার কথা রাত ৯:৩০-এ । আসবে সেই মুম্বাই থেকে। প্রায় ৪০ মিনিট দেরী করে ট্রেনটা এলো। আমাদের টিকেট দুটো ছিল টু-টিয়ার এয়ারকন্ডিশনড ক্যাটেগরির। এর অর্থ ৪ বার্থ বিশিষ্ট ছোট একটা কুপের দুটো বার্থ আমাদের। সহজেই খুঁজে পেলাম ওটা। পরিচয় হল অন্য দুজন সহযাত্রী বয়ষ্ক এক দম্পতির সাথে। ওনারা সাহারানপুর বলে এক জায়গায় নামবেন। দিল্লী থেকে ট্রেনে প্রায় ৪ঘন্টার পথ। ভদ্রলোক একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা, আচরণে গম্ভীর ও সতর্ক ভাব। তাই আলাপ বেশী জমলো না ... হাঁ, ইয়েসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলো কথাবার্তা। যদিও পরে ওনার সৌজন্যবোধ আমাদের মুগ্ধ করেছে। অন্যদিকে ভাষার ব্যবধান সত্ত্বেও মুনের সাথে ভদ্রমহিলার আলাপ জমে উঠলো। ছবি তোলা হল কয়েকটা। দাওয়াত পেলাম সাহারানপুর বেড়ানোর। বার বার বললেন ওনাদের সাথে নেমে যেতে, বড় বাসা, থাকার জায়গার অভাব নেই। পরে অমৃতসর পৌঁছে দেয়া হবে আমাদের। আল্লাহকে ধন্যবাদ, সদ্যপরিচিত মানুষের ভালবাসায় আরেকবার সিক্ত হলাম।

রাত ১০:৩০ এ ট্রেন ছাড়ার সাথে সাথে ডিনারের অর্ডার নিতে এলো এটেনডেন্ট। ভারতীয় খাবারের বৈচিত্র্য আমাদের টানে। তাই যাত্রা পথে সুযোগ পেলেই চেষ্টা করি অপরিচিত খাবারের স্বাদ নিতে। দুই রকম খাবার - ভেজ (নিরামিষ) ও নন-ভেজ (আমিষ)। দুটোরই টেস্ট নেয়ার জন্য একটা করে অর্ডার দিলাম। সহযাত্রী দম্পতি দেখি বাক্স খুলে খাবার বের করছেন। রুটি, ডাল, সব্জি এবং অবধারিতভাবে আচার। ওদের ভেজ নন-ভেজ সবখাবারের সাথে আচার থাকবেই। আমাদের ডিনার আসা পর্যন্ত ওনারা অপেক্ষা করলেন। তারপর শুরু হল সাধাসাধি। ভদ্রমহিলার প্রবল মাতৃভাব আমাদের বাধ্য করল ওনাদের খাবারে ভাগ বসাতে। ডিনার শেষে ছোট একটা ঘুমের আয়োজন করলেন ওনারা। ঠিক ২:১৫ টার দিকে সাহারানপুর পৌছুল ট্রেন। নামার সময় মুনকে আদর করলেন ভদ্রমহিলা। বিদায় হ্যান্ডশেকের সময় প্রথম হাসি দেখলাম ভদ্রলোকের মুখে। পুরো কুপেটা এখন আমাদের। সাহারানপুর থেকে আর কেউ উঠেনি।


খুব ভোরে আবছা অন্ধকারের মধ্যে বিরাট ট্রেনটা প্রবেশ করল অমৃতসর ষ্টেশনে। শীতের ভোরে জবুথবু হয়ে থাকা ষ্টেশনটা মূহুর্তে গমগম করে উঠলো যাত্রীদের কোলাহলে। ট্রেন থেকে নেমে চিন্তা করছি কোনদিক দিয়ে বের হব। সবচেয়ে বেশি মানুষ যেদিক দিয়ে বের হচ্ছে আমরা সেদিক রওনা হলাম। ষ্টেশন থেকে বের হয়ে অবাক! এতো মানুষ নামলো ট্রেন থেকে অথচ বাইরে ২/৩টা সিএনজি স্কুটার, ৩/৪টি রিক্সা আর সেগুলোর ড্রাইভার ছাড়া কেউ নাই। সবাই ঝটপট নিজ নিজ গন্তব্যে রওনা দিয়েছে। বাইরে বিবর্ণ ধোঁয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি দেখে দুজন সিএনজি ড্রাইভার এগিয়ে এলো। হিন্দী নয় সম্ভবত পাঞ্জাবী ভাষায় কি বলল বুঝলাম না, খালি একটা শব্দ বুঝলাম মাইজি ... আর ভাবে বুঝলাম কোথায় যাব জানতে চাচ্ছে। মোটা-সোটা ড্রাইভারের ঢুলু ঢুলু লাল চোখ, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, নোংরা পোষাক দেখেই ওকে নেয়ার চিন্তা বাতিল করে দিলাম। কিন্তু পিছু ছাড়েনা, অন্য ড্রাইভারদের ডাকলেও আসে না, বুঝলাম একটা সমঝোতা আছে এদের মধ্যে। মুন ইশারায় সম্মতি দিতেই মনে মনে বিসমিল্লাহ বলে উঠে বসলাম স্কুটারে। বাংলা-হিন্দী-ইংরেজী মিশিয়ে বললাম একটা ভাল হোটেলে নিয়ে যেতে। দেখি এই সন্ত্রাসী চেহারার ড্রাইভার কোথায় নিয়ে যায় আমাদের! পরবর্তীতে আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। যশওয়ান্ত সিং নামের এই পাগড়ী-দাড়ি ছাড়া হতদরিদ্র শিখ ড্রাইভার তার নির্লোভ আন্তরিকতা দিয়ে আমাদের মন জয় করে নেয় এবং অমৃতসরে আমাদের প্রায় ১৬ ঘন্টার আনন্দময় অবস্থানের এক উল্ল্যেখযোগ্য স্মৃতিতে পরিণত হয়।
======================================

অমৃতসর

ষ্টেশন থেকে খানিকটা দূরে মূল শহর। ঢাকার মতই সিএনজি স্কুটারটা, শুধু রং আলাদা, কালো-হলুদ। ওরা বলে অটোরিকশা। ড্রাইভার সারাক্ষণ হিন্দী পাঞ্জাবী মিলিয়ে বকবক করতেই থাকলো। আমি খাঁটি বাংলায় তাল মেলানোর চেষ্টা করলাম। সাপ্তাহিক ছুটির দিন রবিবার ভোর দেখে হয়ত রাস্তাঘাট জনশূন্য। ফাঁকা রাস্তায় দ্রুত ছুটে চলা স্কুটারে বসে মনে করার চেষ্টা করলাম অমৃতসর সম্বন্ধে কি পড়েছি।

অমৃতসর একটি পাঞ্জাবী শব্দ, এর অর্থ অমরত্বের সরোবর। ১৫৭৪ সালে শিখ সম্প্রদায়ের ১০ গুরুর ৪র্থ জন, গুরু রাম দাশ এ শহর প্রতিষ্ঠা করেন। অমৃতসর সারা বিশ্বের শিখ ধর্মাবলম্বীদের প্রধান তীর্থ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এখানেই শিখদের পবিত্র মন্দির হরমন্দির সাহিব বা গোল্ডেন টেম্পল বা স্বর্ণমন্দির অবস্থিত। স্কুলে পড়েছিলাম ১৯১৯ সালে এ শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণে শত শত লোক মারা যায়, প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাইটহুড খেতাব ত্যাগ করেন। ১৯৮৪ সালে শিখ চরমপন্থিদের দমনের জন্য গোল্ডেন টেম্পলে ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে পরিচালনা করা হয় অপারেশন ব্লু স্টার, যার ফলশ্রুতিতে তাঁকে নিজ দেহরক্ষীর হাতে জীবন দিতে হয়। ভারতের সীমান্তবর্তী এ শহর থেকে পাকিস্তানের লাহোর মাত্র ৩২ কিলোমিটার দূরে। এ শহরের উপর দিয়েই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দিল্লী-লাহোর মৈত্রী বাস ও সমঝোতা এক্সপ্রেস নামের ট্রেন চলাচল করে।


চওড়া রাস্তার পাশে একটা দোতলা হোটেলের সামনে থামলো সিএনজি। ড্রাইভার স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে লাগেজ নামিয়ে লাউঞ্জে রাখল। ঘুমজড়ানো চোখে ম্যানেজার আসতে আমাদের পাসপোর্ট তার হাতে দিয়ে রুম দেখতে গেলাম। ফিরে এসে দেখি সে গম্ভীর মুখে সরি বলছে। আমাদের রুম দিতে পারবে না, ভালো হয় যদি আমরা অন্য কোন হোটেলে যাই। কি কারণ ষ্পষ্ট করে বলে না। কি আর করা, বের হয়ে এলাম। ড্রাইভার যশওয়ান্ত সিং হিন্দীতে যা বললো, দিনকয়েক আগে একদল বাংলাদেশী নারী ও শিশু অবৈধ ভাবে পাকিস্তান যাওয়ার সময় অমৃতসর পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। তারপর থেকে পুলিশী ঝামেলার কারণে হোটেলগুলো সাবধান হয়ে গেছে। বাংলাদেশী পাসপোর্ট দেখলেই ইতস্তত ভাব দেখায়। পরে জানলাম পাকিস্তানে এবং সেখান থেকে মধ্যপ্রাচ্যে মানব পাচারের একটা রুট হলো অমৃতসরের কাছে ওয়াগা বর্ডার।


পরের হোটেলটাতে কোন সমস্যা হলো না। আমাদের হয়ে যশওয়ান্ত সিং ম্যানেজারকে ঘটনা খুলে বললো। ম্যানেজার পাসপোর্ট দেখার ঝামেলাতেই গেল না। সরাসরি কলকাতার একটা ঠিকানা দেখিয়ে আমাদের ভারতীয় হিসাবে নাম রেজিস্ট্রি করে ফেললো। জিজ্ঞেস করলাম, পুলিশ টের পেলে? তিনি হিন্দী এ্যাকসেন্টে বাংলায় বললেন, আপুনারা বাংগালী আছেন ... বাংগালীকে আমি ভালো জানি। কুনু চিন্তা করবিন না। তারপরও একটু ভয় লাগছিল দুজনের। শহরের দ্রষ্টব্য স্থান দেখার কথা জিজ্ঞেস করলাম। কথাবার্তা আঁচ করে ড্রাইভার এগিয়ে এসে আমাদের গাইড হওয়ার প্রস্তাব দিল। যতক্ষণ থাকবো এখানে সে আমাদের সব ঘুরিয়ে দেখাবে এবং সবশেষে দিল্লীর বাসে উঠিয়ে দিবে। হোটেল ম্যানেজারের মধ্যস্থতায় ঠিক হল ১০:৩০টায় আমরা শুরু করব।
======================================
মন্দির

বেরোতে বেরোতে ১১টা বেজে গেল। অমৃতসরের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার জন্য আমাদের হাতে মাত্র ৬ ঘন্টা আছে । কারণ সন্ধ্যার আগে আগে বেশিরভাগ স্থান বন্ধ হয়ে যায়। শহর দেখা শুরু করার আগে আমাদের ফেরাটা নিশ্চিত করতে দিল্লীগামী বাসের টিকেট কেটে ফেল্লাম।

অমৃতসরে দেখার অনেক কিছুই আছে। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে আমরা মাত্র তিনটা জায়গা দেখবো বলে ঠিক করলাম - স্বর্ণমন্দির, ওয়াগা বর্ডার ও জালিওয়ানওয়ালাবাগ। বার বার স্বর্ণমন্দিরের কথা বলছিলাম দেখে আমাদের ড্রাইভার ও গাইড যশওয়ান্ত মিয়া ধরে নিল আমরা বোধহয় শহরের সব মন্দিরস্থাপনাগুলো দেখতে আগ্রহী। প্রথমে নিয়ে গেল ছোট একটা মন্দিরে। নাম লাল দেবী মাতা মন্দির। হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য হলেও সন্তান কামনায় এখানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষ এসে থাকেন। এরপর নিয়ে গেল দূর্গা দেবী মন্দিরে। ওখানে প্রবেশ করে প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম এটাই বুঝি স্বর্ণমন্দির। কারণ স্বর্ণমন্দিরের যে ছবি দেখেছিলাম দূর্গামন্দিরটা হুবহু সে রকম। পরে অবশ্য ভুল ভেঙ্গেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এই মন্দিরের ডিজাইন শিখ স্বর্ণমন্দিরের একটা দূর্বল অনুকরণ।






স্বর্ণমন্দির

দুটো জায়গা দেখতেই আমাদের ২ ঘন্টা খরচ হয়ে গেল। যশওয়ান্তকে দিলাম ঝাড়ি ... সিধা সরন্ মান্দির চল্ যাও। সাথে বাংলায় যোগ করলাম ... ডাইনে বাঁয়ে যাবাতো খবর আছে। যথারীতি সরল হাসি দিয়ে অটো টান দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেলাম আমাদের কাংখিত স্বর্ণ মন্দিরে। পূর্বদিকের প্রধান গেইট দিয়ে প্রবেশ করে এর বিশালত্ব দেখে অবাক হলাম।


১৫৭৪ সালে ৪র্থ শিখ গুরু রামদাশ স্বর্ণমন্দির ও অমৃতসর শহর প্রতিষ্ঠা করেন। এর জন্য জমি দান করেছিলেন সম্রাট আকবর। ১৫৮৮ সালে মন্দিরটা পূর্ণাঙ্গরূপে নির্মিত হয় ৫ম গুরু অর্জুন দেব কর্তৃক। মজার ব্যাপার, নতুনরূপে নির্মিত মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত করেন অর্জুন দেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেসময়ের লাহোরের এক বিখ্যাত মুসলিম সাধক হযরত মিয়া মির।


সরোবরের মাঝে অবস্থিত দুইতলা মন্দিরটির প্রথম তলা মার্বেল পাথরে তৈরী। দোতলার বাইরের দেয়াল ২৪ ক্যারেট সোনার পাত দিয়ে মোড়ানো। ১৮৩০ সালে পাঞ্জাবের মহারাজা রনজিত সিং ১০০ কেজি সোনা এ উদ্দেশ্যে দান করেন। ১৯৯৯ সালে পুরোনো সোনার পাতগুলো পরিবর্তন করে নতুন স্বর্ণপাত দ্বারা ঢেকে দেয়া হয়। মন্দিরে দানকৃত স্বর্ণালংকার থেকে এই বিপুল পরিমাণ সোনা সংগ্রহ করা হয়।


মন্দিরের চারদিকে চারটি প্রবেশপথ আছে। এর মানে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই সবদিকে দিয়ে এখানে প্রবেশ করতে পারবে। প্রবেশের সময় খালি পায়ে মাথা ঢেকে রাখার নিয়ম। ভিতরে এ্যালকোহল, ধূমপান বা যে কোন ধরণের মাদক ব্যবহার এবং মাংস ভক্ষণ সম্পূর্ণ নি্ষিদ্ধ। সকাল ৬টা থেকে ভোর ২টা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে।









সারাদিন কাটিয়ে দেয়া যায় এরকম একটা জায়গা এই স্বর্ণমন্দির। ঠিক করলাম, ম্যাক্সিমাম সময় এখানে থাকবো। দরকার হলে আর কোথাও যাবো না।
======================================
হালকা শপিং
প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিনটার দিকে স্বর্ণমন্দির থেকে বের হলাম। সাড়ে তিনটার মধ্যে ওয়াগা বর্ডারের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হবে, যশওয়ান্ত সতর্ক করে দিয়েছিল। তা না'হলে ভারতীয় ও পাকিস্তানী সীমান্তপ্রহরীদের যৌথভাবে পতাকা নামানো ও গার্ড বদলের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান মিস হয়ে যাবে। স্বর্ণমন্দিরের চারপাশে ছোট ছোট অসংখ্য দোকান। অনেকটা ঢাকার চকবাজারের মতো।এই মার্কেটটার নাম গুরু বাজার। আমাদের যেটুকু সময় আছে তাতে আলাদা করে শপিং করা সম্ভব না। তাই আগেই ঠিক করা ছিল 'নো শপিং'। কিন্তু চোখের সামনে গুরু বাজার দেখে 'এই একটু দেখে আসি' টাইপের ভঙ্গি করে গুট গুট পায়ে মার্কেটে ঢুকে পড়লো মুন। অমৃতসর এমব্রয়ডারী, কাঠের উপর সুক্ষ কাজ, উলেন পোশাক ও গহনার জন্য বিখ্যাত। যতই আমি তাড়া দেই ও ততোই 'এই একটু' করতে করতে বেশ কয়েকটা উলেন সোয়েটার ও শাল কিনে ফেললো। এখানে একই পোশাকের দাম দেখলাম ঢাকার তুলনায় কয়েকগুণ সস্তা। অনেক কষ্টে মুনকে শপিংএর বৃত্ত থেকে বের করে এনে দেখি ৪টার বেশি বেজে গেছে। তার মানে ওয়াগা বর্ডার দর্শন ভন্ডুল। আমাদের ড্রাইভারও খানিকটা উষ্মার স্বরে তাই বললো। বল্লাম, কি আর করা ... তাহলে চলো দেখে আসি তালিকার শেষ দর্শনীয় স্থান জালিওয়ানওয়ালাবাগ।

জালিওয়ানওয়ালাবাগ

অমৃতসরের অন্যতম ট্যুরিষ্ট আকর্ষণ জালিওয়ানওয়ালাবাগ। যাঁরা গান্ধী ছবিটি দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জালিওয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের দৃশটির কথা মনে করতে পারবেন যেখানে নিরস্ত্র মানুষের উপর ব্রিটিশ সেনারা গুলিবর্ষণ করছে। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল ছিল শিখদের কাছে পবিত্র বৈশাখী উৎসব দিবস। এ উপলক্ষ্যে প্রচুর সাধারণ মানুষ পরিবার সহ একটি সমাবেশে জড় হয়েছিলেন জালিওয়ানওয়ালাবাগে। তাঁদের অনেকেই জানতেন না যে একইসাথে সেটি ছিল সেসময়ের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সভা। সভাচলাকালীন চারিদিক প্রাচীর ঘেরা পার্কে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে ৯০ জন সেনা প্রবেশ করে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। ১০-১৫ মিনিটের এই ম্যাসাকারে ১৫০০ -এর বেশি নিরস্ত্র মানুষ গুলিতে ও পদদলিত হয়ে নিহত হন। আহত হন শত শত। রবীন্দ্রনাথ এই গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে তাঁর নাইটহুড খেতাব ত্যাগ করেন।






গুলিবর্ষণ থেকে বাঁচার তাগিদে অনেক মানুষ পার্কের একটি কূপে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে। পরবর্তীতে সেখান থেকে ১২০টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। কূপটি সংরক্ষিত কিন্তু বর্তমানে বন্ধ।




শহীদদের স্মরণে ওখানে সুন্দর একটি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।




সন্ধ্যার মুখে বের হলাম জালিওয়ানওয়ালাবাগ থেকে। খুব বেশি সময় হাতে নেই আর। ঠিক করলাম হোটেলে ফিরে যাবো, তারপর ৮টার দিকে ডিনার করে বাসের উদ্দেশ্যে রওনা দিব। রাত সাড়ে ১০টায় বাস।


ডিনারে

ডিনারের জন্য অনেক রাস্তা ঘুরে সরু একটা গলির শেষ মাথার ধাবায় গেলাম। ছোট, পরিচ্ছন্ন কিন্তু খুব ব্যস্ত ধাবা। পরে দেখেছি খাবারটাও খুব স্বাদু। আমাদের অটোড্রাইভার ও গাইড যশওয়ান্ত সিংকে অনেক বল্লাম সাথে ডিনার করতে, কিন্তু বিচিত্র কারণে রাজি হলো না। অথচ ভারতের অন্যান্য শহরে আমাদের অভিজ্ঞতা অন্যরকম। ডিনারের মেনু মাখন দেওয়া রুটি ও ঝাল তড়কা। ধাবায় মাটন ও চিকেন কারীও পাওয়া যায় কিন্তু আমরা স্থানীয় খাবার টেস্ট করতে ঐটার অর্ডার দিলাম। জম্পেশ ডিনার হল। বের হওয়ার দরজার কাছে টেবিলে খুবই মজার পানমশলা রাখা। মুন খুব আগ্রহের সাথে দেখছে দেখে কি মনে করে ধাবার বয়স্ক শিখ ম্যানেজার মাইজি'র (মুন) জন্য প্রায় আধাকেজি পরিমাণ স্পেশাল পানমশলা দিয়ে দিল।

বিদায়বেলায়

সাড়ে ৯টার দিকে বাসস্ট্যান্ডে চলে এলাম। আর মাত্র এক ঘন্টা আছি অমৃতসরে। যশোওয়ান্ত সারাদিন হাসিমুখে সার্ভিস দিল। আর এখন দেখি মুখ গম্ভীর। আমাদেরও মন ভার ভার। ৬ কন্যার জনক ও। জিজ্ঞাসা করে জানলাম নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। কিন্তু সরল হাসি লেপটে আছে মুখে সারাক্ষণ। ওর পাওনা মিটিয়ে অতিরিক্ত কিছু টাকা দিতে চাইলাম। নিবে না কিছুতেই, শেষে মুনের ধমকে নিল। তারপর এক কান্ড করলো। দৌড়ে রাস্তার ওপার থেকে এক বোতল ব্যাগপাইপার নিয়ে আসলো। এটা খেলে নাকি রাতে ট্রাভেলের কষ্ট টের পাবোই না ... মাইজিকে বলার দরকার নাই ... ব্যাগে ঢুকিয়ে নাও। আমি হাসি চেপে ফিরিয়ে দিলাম ওকে। সে তার মতো করে প্রতিদান দিতে চেয়েছে। তারপরও মন ছুঁয়ে গেল। বাস ছেড়ে দিল নির্ধারিত সময়ের কিছু পরে। নতুন করে তৈরী করা পাঞ্জাব-দিল্লী হাইওয়ে ধরে দিল্লী পৌঁছলাম সুনসান হিম ভোরে। সাঙ্গ হলো আমাদের ঝটিকা সফর।







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন